সালিস প্রক্রিয়াকে গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর এক প্রশংসনীয় প্রয়াস

March 23, 2024

22.03.2024: বাংলাদেশে আইনবিষয়ক মৌলিক বা ব্যাখামূলক বইয়ের এক নিদারুণ সংকট চলছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও—এই দুঃখজনক সত্যটা আমাদের মেনে নিতে হয়। আমাদের আইনজীবী বা বিচারকরা আজও আইনের ব্যাখ্যার জন্য ইংলিশ বা ভারতীয় আইনবেত্তাদের কাজের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। নজিরভিত্তিক ব্রিটিশ আইনের উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের দেশের মৌলিক আইনগুলো প্রণীত হলেও ইংরেজি ভাষাতেও এসব আইনের ওপর তেমন কোনো উল্ল্যেখযোগ্য কাজ হয়নি। বাংলা ভাষায় আইনের ওপর লেখালেখির বিষয়টি তাই বলাই বাহুল্য।

সেই প্রেক্ষিত থেকে সালিস আইনের উপরে সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া ‘Commentaries on the Law of Arbitration in Bangladesh—বাংলাদেশের সালিশ আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ’ বইটি আইন অঙ্গনে এক উল্ল্যেখযোগ্য সংযোজন। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সালিস আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরীর এই দ্বিভাষিক বইটি কেবল সালিস আইনের মত জটিল একটি বিষয়ের ভাষ্য শুধু নয়, বরং দেশে আইন বিষয়ে জ্ঞানের প্রাপ্যতার এক নতুন দিগন্তও উন্মোচিত করেছে। একই সাথে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা বইটি পাঠক যে ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সে ভাষাতেই পড়তে পারবেন। সালিসের জটিল আইনি দিকগুলোর ব্যাখ্যা এবং এর চর্চাকে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য লেখকের এই পাহাড়সম পরিশ্রমকে সাধুবাদ দিতে হয়।

আদালতের প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে নিজস্ব পছন্দে, ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং কম সময়ে কোন বিবাদ মিটিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটিই হলো সালিস। সহস্রাব্দকাল আগ থেকেই আমাদের ভূখণ্ডে বিভিন্ন আঙ্গিকে সালিস প্রচলিত ছিল, যার আভাস পাওয়া যায় যাজ্ঞবল্ক্য বা নারদ মুনির লেখায়। সভ্যতার পথপরিক্রমায় বিশেষ করে বাণিজ্যের বিশ্বায়নের সাথে সালিস প্রক্রিয়াতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা UNCITRAL-সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ এবং চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই যেন একই আইনি কাঠামোতে থেকে সালিস প্রক্রিয়া পরিচালনা করা যায়, তার জন্য তৈরি হয়েছে মডেল আইনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রণয়ন করে সালিস আইন-২০০১। তবে সময়ের সাথে এই আইনটির পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা এসেছে। বিভিন্ন মামলার প্রেক্ষিতে ধরা পড়েছে এই আইনের নানা প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতা।

সালিস আইনের উপর ব্যারিস্টার চৌধুরীর লেখা বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে রয়েছে ভূমিকা, সালিসের ধারণা এবং ইতিহাস ও বাংলাদেশে সালিসের ক্রমবিবর্তন। এ পর্বে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পাশাপাশি আধুনিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে সালিস আইনের ক্রমবিবর্তনের এক আলেখ্য উঠে এসেছে। আদালতের আওতার বাইরে থাকা সালিসের উপর আদালতের বিচারক-আইনজীবীদের জমে থাকা বিতৃষ্ণা বা আস্থাহীনতা কিভাবে কমে এসে একপর্যায়ে সালিস জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তার একটি চিত্র রয়েছে এখানে।

মজার বিষয় হলো, যেখানে সালিস আইনের চর্চা এখনো নবীন (যেমন বাংলাদেশ), সেখানে আইনসংশ্লিষ্টদের এই অস্বস্তি এখনও সম্পূর্ণভাবে দূর হয়নি। ফলে প্রায়ই সালিস প্রক্রিয়ায় আদালতের অযাচিত হস্তক্ষেপ দেখা যায়। বইটির তৃতীয় পর্বে লেখক এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

দ্বিতীয় পর্বে সালিস আইন, ২০০১-এর ধারাভিত্তিক বিবরণীতে আইনটির বিশদ পর্যালোচনা রয়েছে। এই পর্বে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে সালিসবিষয়ক এ যাবত প্রকাশিত সব মামলার রায়ের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আদালতের সালিসবিষয়ক মাইলফলক রায়ের তুলনামূলক পর্যালোচনা হয়েছে। এছাড়া সালিসের সংজ্ঞা, সালিস চুক্তি, সালিসকারী নিয়োগ, সালিস পরিচালনা পদ্ধতি, সালিসের রোয়েদাদ (রায়) বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, আদালতের হস্তক্ষেপ, বিভিন্ন আইনি কৌশলের প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগসহ আমাদের আইনটির যে প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতাগুলো রয়েছে, তা তুলে ধরার পাশাপাশি লেখক এখানে আদালতের কিছু রায়ে আইনের ভুল বা সীমাবদ্ধ প্রয়োগের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে এনেছেন।

তৃতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে, সালিস আইনের একটি মৌলিক প্রায়োগিক সমস্যা—সালিস প্রক্রিয়ায় আদালতের হস্তক্ষেপ বা সালিস-বিরোধী নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ। এই পর্বে বিদেশে অনুষ্ঠিত সালিসের উপর বাংলাদেশের আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন—এমন দুটি সাম্প্রতিক মামলার রায়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে, সালিস প্রক্রিয়ায় আদালতের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত সতর্ক হওয়া উচিৎ, কেননা এর উপরে বহুলাংশে নির্ভর করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুনাম এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা।

বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিস আইনের প্রয়োগ আমাদের দেশে অনেকটাই বাণিজ্যিক পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ রয়েছে, কিন্তু আইনটিকে আরও ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো যায়। প্রজন্মান্তরে চলতে থাকা জমি-জমা সংক্রান্ত বিবাদ, পারিবারিক বিরোধ, কারিগরী বা প্রযুক্তিগত বিষয়ে বিরোধ বা কোনো চুক্তি লঙ্ঘনের সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন একজন দক্ষ সালিসকারী এবং এর ফলে মামলাজটে ভারাক্রান্ত আমাদের আদালতগুলোও পেতে পারে নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ।

ব্যারিস্টার চৌধুরী বইটিতে সহজ বাংলায় সালিসের জটিল আইনি বিষয়গুলো উপস্থাপন করার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা আদালতে কর্মরত বিজ্ঞ আইনজীবীরাও সালিস আইনের নীতির আলোকে তাদের মক্কেলদের কার্যকরী সমাধান দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হতে পারেন।

সালিস আইন ও এর চর্চাকে আরও কার্যকরীভাবে প্রয়োগের জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন আমাদের আইনটির যুগোপযোগী সংস্কার, তেমনি প্রয়োজন আদালত, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, নাগরিকসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবার সালিসবিষয়ক জ্ঞান ও চর্চার যুগপৎ উন্নয়ন। পাশাপাশি, দেশের মৌলিক আইনগুলো বুঝতে, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আইনবেত্তাদের কাজ বা আদালতের নজিরের সঙ্গে আমাদের অবস্থানের তুুলনামূলক পর্যালোচনা করতে এবং কেবলমাত্র ভাষার মাসে শুধু নয়, বরং দৈনন্দিন সব ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় আইন বুঝতে ও প্রয়োগ করতে আগ্রহী সবার জন্য এই ধরণের কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই, জনাব জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরীর পরিশ্রমলদ্ধ এই বইটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

আর দেশীয় আইনের উপর মৌলিক কাজের শূন্যতা দূর করার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় আইনবিষয়ক মানসম্মত বই লিখতে দেশের বিজ্ঞ আইনজ্ঞরা আরও এগিয়ে আসবেন—এটিই প্রত্যাশা।

বইটি প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।

লেখক: ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী

Read more